
বাংলাদেশের সচেতন বিজ্ঞানী সমাজ ও ‘ভাববৈঠকি’ র আয়োজনে “বাংলাদেশে পরমাণু বিজ্ঞান বিকাশে সম্ভাবনা, সংকট ও উত্তরণের উপায়” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, অদ্য ২১ মে ২০২৫ ইং তারিখে রোজ বুধবার বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের ডঃ আনোয়ার হোসেন অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণায় চলমান অস্থিরতায় সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী সমাজ উদ্বিগ্ন। সে প্রেক্ষিতে দেশের বিজ্ঞান গবেষণার সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিভিন্ন সংকট ও তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায়সমুহ নিয়ে উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব- দার্শনিক, কবি ও লেখক জনাব ফরহাদ মজহার, আলোচনা প্যানেলে অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ জামাল উদ্দিন। আলোচনার প্রারম্ভে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ। স্বাগত বক্তব্যের পর সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ প্রকৌশলী শেখ মঞ্জুরা হক। উপস্থাপনায় বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণার সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণা কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক, সম্ভাবনা, সংকট ও এর থেকে উত্তরণের উপায় ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়। এরপর শুরু হয় পঠিত মূল প্রবন্ধের উপর আলোচনা। আলোচকবৃন্দ তাঁদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা মূলত একটি বিশেষায়িত গবেষণা ও পরিষেবা ক্ষেত্র। অথচ এর নীতিনির্ধারণ, প্রশাসন এবং আর্থিক কাঠামো গভীরভাবে আমলাতান্ত্রিক শৃঙ্খল এবং অযাচিত ও অন্যায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীন। পরমাণু শক্তি কমিশনের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক ডাঃ ফারিয়া নাসরীন এর সঞ্চালনায় পরিচালিত দীর্ঘ ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা শেষে নিম্নলিখিত সুপারিশমালা প্রস্তাবিত হয়ঃ ১। চেয়ারম্যান ও চার সদস্য সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশনকে অপূর্ণাঙ্গ রেখে কিংবা চেয়ারম্যান ও সদস্যদের চলতি দায়িত্বে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে প্রকারান্তরে কমিশনকে নতজানু করার অপকৌশল পরিহার করতে হবে। ২। কমিশনকে নীতিগত সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে খোদ কমিশন পরিচালনার মনোভাব মন্ত্রণালয়কে পরিহার করতে হবে। ফলে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা সহজতর হবে। ৩। উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পূর্বানুমতি, মনোনয়ন এবং জি. ও. প্রদানের এখতিয়ার কমিশনের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। এর ফলে পরমাণু বিজ্ঞানের বিকাশ অবাধ ও অবারিত হবে।
৪। কমিশনের নিউক্লিয় তথ্যের সুরক্ষা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত কল্পে মন্ত্রণালয় কর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন সফটওয়ারে তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা দূর করতে হবে। সেই মোতাবেক কমিশনকে আর্থিক কর্মকান্ড পরিচালনার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। ৫। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যায় পদমানক্রম নিশ্চিত করতে হবে। ৬। মালিক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাথে ‘বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি’ সম্পাদিত হতে হবে। ৭। কমিশনের সকল অস্থায়ী পদ স্থায়ীকরণ, নতুন পথ সৃজন এবং সমধর্মী প্রতিষ্ঠানের ন্যায় কিছু সুযোগ সুবিধা যেমনঃ গৃহনির্মাণ। ফ্ল্যাট ক্রয় ঋণ, রেশন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সুদ মুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন সুবিধাদি চালু করতে হবে। ৮। মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরীর সূতিকাগার হচ্ছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। এর সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে মন্ত্রণালয় সৃষ্ট সকল কৃত্রিম বাধা দূর করতে হবে। ৯। ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দের অবমাননাকর অবস্থান উন্নীত করনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১০। পরমাণু বিজ্ঞানসহ দেশের সকল পর্যায়ের বিজ্ঞানের বিকাশ সাধনে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, মুক্তচিন্তার পরিবেশ তৈরিসহ মৌলিক গবেষণার পথ প্রসারিত করতে হবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান সচেতন সমাজ, আজকের সভার আলোচকবৃন্দ এবং সর্বোপরি ‘ভাববৈঠকি’ মনে করেন যে, যথাযথ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা না থাকা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতা বিশেষ করে আমলাদের সংকুচিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাংলাদেশে বিজ্ঞান-চর্চা ও এর অপার সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিজ্ঞান গবেষণা বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সামষ্টিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের উদ্দেশ্য গণ-সার্বভৌমত্বের আলোকে পরমাণু শক্তি কমিশন আইন ২০১৭ (ও ২০২২-এর সংশোধনী) এবং বিজ্ঞানীদের দাবি বিশ্লেষণ করা, বোঝা এবং জনগণের সামষ্টিক স্বার্থের আলোকে হাজির করা।